আলোকিত মুন্সীগঞ্জ ডেস্ক
সব বাধা পেরিয়ে অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দীর্ঘ চ্যালেঞ্জ আর প্রতিকূলতা পেরিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল জাতি, আজ তা বাস্তব। পদ্মার বুকে গৌরবের প্রতীক পদ্মা সেতুর দুয়ার খুলে দেয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই এলো ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তটি। স্বপ্নের সেই সেতু উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে খুলে গেল স্বপ্নের দ্বার।
সেতুর উদ্বোধন শেষে বাংলাদেশের মানুষের সাহস ও আত্মমর্যাদার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বাধীনতার পর এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের কোনও সম্পদ নেই, আপনি কীভাবে দেশ গড়ে তুলবেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার মাটি আছে, মানুষ আছে, তাই দিয়ে দেশ গড়বো।’সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের অর্থনীতি সচল আছে। অনেক প্রকল্প নিয়েছি। পদ্মা সেতু তৈরি করেছি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে যায়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতি করোনা মোকাবিলা করেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ মোকাবিলা করেও গতিশীল আছে। বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে— বাংলাদেশ জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ। জনগণ সাহসের ঠিকানা। বাংলাদেশের জনগণকে আমি স্যালুট জানাই।
দুপুর ১২টার দিকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশের পর মাওয়া প্রান্তে সুইচ টিপে সেতুর ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। আর এর মাধ্যমেই খুলে গেল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অপরাপর অংশের জন্য সংযোগ, যোগাযোগ ও সম্ভাবনার অনন্ত দুয়ার।
দুপুর ১২টার দিকে মাওয়া প্রান্তে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সেখানে উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন। এর আগে তিনি সেখানে মোনাজাতেও যোগ দেন।
উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী মাওয়া পয়েন্ট থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। জাজিরার দিকে যাওয়ার পথে দুপুর ১২টা ১২ মিনিটের দিকে গাড়ি থামিয়ে নেমে যান প্রধানমন্ত্রী। পদ্মা সেতুতে দাঁড়িয়ে তিনি বিমান বাহিনীর মহড়া দেখেন। এরপর ১২টা ২৬ মিনিটে তিনি আবার গাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে তিনি জাজিরা প্রান্তে পৌছান।
জাজিরা প্রান্তেও দুপুর ১২টা ৩৮ মিনিটের দিকে ফলক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে সেখানে মোনাজাত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী মাওয়া প্রান্তে সেতুর উদ্বোধন করে টোল দিয়ে গাড়িতে সেতু পার হয়ে অপর প্রান্তে যান। সেখানে শনিবার ভোর থেকে নেমেছে মানুষের ঢল। দক্ষিণের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ জড়ো হচ্ছে সেখানে। নানা রঙের টি শার্টে, নেচে গেয়ে সমাবেশে আসে মানুষ।
নিছক নদীর উপরে তৈরি সেতু। সে তো কত দেশেই রয়েছে। পদ্মা নদীর উপরে তৈরি সেতু সে হিসেবে ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু একটা সেতু যে একটা গোটা দেশের মানুষের আবেগকে এভাবে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারে, তা অভাবনীয়। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় শুক্রবার যেন বিনিদ্র রাত কেটেছে বাংলাদেশের।
২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে পদ্মা সেতু নির্মাণকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। শনিবার সকালে সেই সেতুর দুয়ার খুললেন তিনি। এই সেতু বিদেশি ঋণ, আর্থিক সাহায্য দয়ার উপরে নির্ভরতা থেকে মুক্তি প্রতীক। কারণ, এই সেতু তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের নিজের অর্থে।
খরস্রোতা পদ্মা এতোদিন বাংলাদেশের দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছিল। আজ মুক্তি মিলল তার থেকে। পদ্মা সেতু একই সঙ্গে তাই একটি গোটা জাতির ভাবাবেগ। উন্নয়নের প্রতীক। আত্মমর্যাদার প্রতীক। সাধারণ মানুষের মধ্যে, পিছিয়ে পড়া এলাকায় উন্নয়নের সুফলকে ছড়িয়ে দেয়ার বার্তাও।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যতবারই হত্যা করো, জন্মাবো আবার; দারুণ সূর্য হবো, লিখবো নতুন ইতিহাস।
তিনি বলেন, বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক রঞ্জিত হয়েছে ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্ত ধারায়। কিন্তু বাঙালি আবার সদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
উৎসবের এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতির উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আসুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই ঐতিহাসিক দিনে যে যাঁর অবস্থান থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার শপথ নিই, এ দেশের মানুষের ভাগ্য পবির্তন করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-কনক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। এ সেতু বাংলোদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িত আছে আমাদের আবেগ, সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয়, জেদ। যে জেদের কারণে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর প্রতিটি স্তম্ভ স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। উৎসবের এই মুহূর্তে দেশের মানুষকে স্যালুট জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের সমর্থন আর সাহসেই তিনি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠিন কাজটি সম্ভব করতে পেরেছেন।
সেতু নির্মাণ কাজের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, যারা এ প্রকল্পের জন্য বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে দিয়েছেন, সবার প্রতি তিনি জানান কৃতজ্ঞতা।
প্রধামন্ত্রী জানান, আপনারা সবাই জানেন, এ সেতু নির্মাণ করতে যখন আমরা যাই, অনেক ষড়যন্ত্র শুরু হয়, মিথ্যা অপবাদ, দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে একেকটি মানুষ, একেকটি পরিবারকে যে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে, আমার ছোট বোন শেখ রেহানা, আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, আমার মেয়ে সায়মা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, আমার অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা, পদ্মাসেতু নির্মাণে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলাম ড. মসিউর রহমানকে, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া… যারা এর সাথে জড়িত ছিল, তাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়, তাদের পরিবারসহ যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, আমি তাদের প্রতি সহমর্মিমতা জানাই।
শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেতু নির্মাণের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, সকল প্রকৌশলী, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশি-বিদেশি পরামর্শক, ঠিকাদার, প্রযুক্তবিদ, শ্রমিক, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রিতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
দেশের সবচেয়ে বড় এ যোগাযোগ অবকাঠামোর উদ্বোধন উপলক্ষে পদ্মার দুই তীরের পাশাপাশি সারা দেশে শুরু হয় উৎসব। শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকার তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে রওনা হয়ে ঠিক ১০টায় মাওয়ায় আয়োজিত সুধী সমাবেশের মঞ্চে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে পদ্মা সেতুর থিম সং মাথা নোয়াবার নয়, বাঙ্গালি যেহেতু; বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন দেশ, তুমি দিলে পদ্মা সেতু বাজিয়ে সুধী সমাবেশ শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য দেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমরা যে অল্প সময়ে এই কাজটি শেষ করতে পেরেছি তার একমাত্র এবং প্রধান কারিগর হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি সবকিছু। এ সেতুর মাধ্যমে তিনি জাতিকে আত্মমর্যাদার অধিকারী হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এ সময় তিনি দুই পাড়ের সাধারণ মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আমার ৪০ বছরের চাকরি জীবনে অনেক প্রকল্পে কাজ করেছি। কিন্তু পদ্মা সেতুর খবর যখন তারা শুনল তখন নিজেদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে দিয়েছে এ সেতুর জন্য। যেখানে তারা জীবনের ৫০ বছর কাটিয়েছে সেই আবেগের জায়গা ছেড়ে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর একটি উদ্যোগে। তাদের কোনো দুঃখ নেই এখন। তারা ভিটেমাটি হারিয়ে গর্ববোধ করছেন।
সচিব বলেন, দুই পাড়ের মানুষ শুরুর দিকে আমাদের জানায়, তাদের ভিটেমাটির উপর পদ্মা সেতু হচ্ছে এটাই তাদের গর্ব।
এ সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর বীরকন্যা আপস করেননি বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এসময় তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর বীরকন্যা আপোষ করেননি। সাহসের সঙ্গে এগিয়ে গেছেন। বাধাকে অতিক্রম করে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন বাঙালী বীরের জাতি।
স্থানীয় মানুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, আপনাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আপনারা এই সেতু নির্মাণে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আপনার পৈতৃক সম্পত্তি, ফসলি জমি ত্যাগ করেছেন।
সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আজ বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে শেখ হাসিনা যতদিন থাকবে ততদিন বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। কাজেই নির্বাচনের প্রশ্নে সবাই উদগ্রীব হয়ে বসে আছেন আবারও প্রধানমন্ত্রীকে জয়যুক্ত করার জন্য।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, আমি মনে করি শুধু পদ্মা সেতু না, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সম্ভাবনার বাংলাদেশ তৈরি করে দিয়েছেন, আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, এটার জন্য তিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন।
প্রসঙ্গত, শনিবার (২৫ জুন) সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা বহুমুখী সেতুর উদ্বোধন করেন। মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে ভাষণ শেষে তিনি উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অপরাপর অংশের জন্য সংযোগ, যোগাযোগ ও সম্ভাবনার অনন্ত দুয়ার।
৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। মাওয়া থেকে জাজিরা। পদ্মা সেতু সড়ক, রেল, গ্যাস, বিদ্যুতের সংযোগ ঘটাবে উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের। নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে আছে সংযোগ সড়ক, রেল সংযোগ, নদীশাসন, পুনর্বাসন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ নানা প্রকল্প ও কর্মকাণ্ড। এরপর তিনি দুপুরে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য দেন। এর আগে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন বেলা ১২টা ৫৩ মিনিটে মাদারীপুরের শিবচরের সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী।
Be the first to comment on "পদ্মা সেতু উদ্বোধন,স্বপ্নের উন্মোচন"