গত ২ মে বৃহস্পতিবার সকালের দিকে ফোন দিলেন বেতকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাচ্চু শিকদার ।জানালেন,একটা দশ/ এগার বছরের ছেলে পাওয়া গিয়েছে আগের দিন দুপুরে ।ছেলেটি ঘুরছিল উদ্দেশ্যহীন, চৌরাস্তার মোড়ে।বললেন,”স্যার,একে নিয়ে কী করবো,একরাত ছিল আমার বাড়িতে।ঠিকানা বলতে না পারায় থানা দায়িত্ব নিচ্ছে না।”সেদিন বেশ কয়েকটা প্রোগ্রাম ছিল।”লাঞ্চের পর বসবো,তখন নিয়ে আসেন অফিসে”,জানিয়ে দিলাম।
এলো।চেহারায় মায়া আছে।
নাম,বাবা মায়ের নাম,ঠিকানা জিজ্ঞেস করায় সে জানালো,সাদিক,বাবা-বাদশা,মা-,নাসিমা।কোথায় বাড়ি তোমার, প্রশ্নের উত্তরে জানালো, নরসিংদী ।বিভিন্নভাবে জানার চেষ্টা করলাম,নরসিংদীর কোথায় বাড়ি।সব প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলে,আইচ্ছা।শেষে অনেকভাবে জিজ্ঞেস করার পর ‘পাঁচকান্দি’ নামটা জানা গেল। ।এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক,মুন্সীগঞ্জ Saila Farzana স্যারের পরামর্শ নিলাম।স্যার নিজেই নরসিংদীর ডিসি স্যারের সাথে কথা বলতে চাইলেন। স্যার শেষে বললেন নিতান্তই ঠিকানা না পেলে আপাতত শ্রীনগরের ‘শিশু পরিবার’ এ পাঠিয়ে দিতে।
পাঁচকান্দি নামটা শোনার পর ভাবলাম,এই ত সহজ হয়ে গেল,যদি শিশুটি ঠিকঠাক বলে থাকে।নরসিংদীর এনডিসি’র সাথে যোগাযোগে জানা গেল মনোহরদি উপজেলায় আছে এই নামে একটি জায়গা।উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বললে সে জানালো, একটা ছবির প্রয়োজন।ছবি পাঠিয়ে অপেক্ষার পালা।ক্রমশ হতাশ হচ্ছিলাম,হয় ত পাওয়া যায় নি।
বিকেল থেকে শ্রীমান আমার বাসায় ।একজনকে সার্বক্ষণিক লাগিয়ে রাখা হলো,যদি পালিয়ে যায়।
ওহ্ বলা হয় নি,ছেলেটা কিছুটা অস্বাভাবিক ।কথা বলে না বেশি,ঠায় বসে থাকে।সন্ধ্যায় খাবার দিলে খেয়ে বাচ্চাদের খেলা দেখতে দেখতে ঘুম।
অফিস ছিলাম,বারবার খবর নিচ্ছিলাম,ছেলে কী করে।বাসা থেকে জানানো হলো ,ঘুমায়।
অবশেষে সাড়ে নয়টার পর জানতে পারলাম,ছেলেটি ওখানকারই। কৃতজ্ঞতা Saila Farzana, DC Munshigonj স্যারের প্রতি,Shafia Akter Shimo,Uno Monohardi Narsingdi’র প্রতি।
যাই হোক, সকাল আটটায় ঘুম ভাঙলে তাকে খবরটি দেয়া হলো।কী যে এক আলো ফুটে উঠলো মুখমণ্ডলে!যাই হোক,আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম।সবকিছুর উত্তর একটাই ,আইচ্ছা।
শেষ পর্যন্ত এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।দুপুর বেলায় ।ওর মা এলো।দেখে কী যে অস্বাভাবিক এক্সপ্রেশন তার !মাকে জড়িয়ে ধরার পর প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।ভাষাহীন, অনেক কথাই বলে ফেললো।
জানা গেল,ছেলেকে শিকলে বেঁধে রাখতে হয়, কারণ,মা গার্মেন্টস করে।স্বামী ছেড়ে চলে গেছে আড়াই বছর আগে অন্য ঘর করার জন্য ।এখন ওখানে সন্তানও রয়েছে ।
মা জানালেন,আগে তার ছেলে এমন ছিল না।স্কুলেও যেত,আরবী শিক্ষাও লাভ করেছে।এর প্রমাণ পেয়েছি,পত্রিকা ধরেছিলাম তার সামনে,সকালে,যখন পত্রিকাওয়ালা এসেছিল।
মা জানাল,ছেলেটির আগে মৃগী রোগ ছিল,পরবর্তীতে যখন বাবা ছেড়ে গেল তাদের ,ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করে।পায়ে পড়ে শিকল।পঁচিশ দিন আগে গোসলের সময় তার শিকল খোলা হলে ভোঁ দৌড়।মা আর খুঁজে পায় নি।
যাক এসব।আজ মা দিবস।দিবসটিকে সার্থক করতেই বোধ হয় মায়েরা এভাবে সন্তানকে আগলে রাখার চেষ্টা করে,শিকল দিয়ে হলেও।তার আর কীই বা করার ছিল!তার নিজেরও যে মা নেই,সৎ মা।কার কাছে রাখবেন সন্তান?
কিছু বাবা অবলীলায় চলে যায় আত্মজকে ছেড়ে।ফলাফল ,ব্রোকেন ফ্যামিলি।সাদিকের মতো শিশুরা নিতে পারে না এই চাপ,ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মনের।মা রোজগারে বেরিয়ে পড়েন।মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধটাকে চালিয়ে নিতে হবে তো!
আমার মা ও অ-নে-ক দূরে।ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া হয় না হুটহাট।
প্রার্থনা রইলো,প্রত্যেক মা আর সন্তান কাছাকাছি থাকুক,পাক একটা নিরাপদ জীবন।পঁচিশ দিন ধরে যেন কোন মাকে খুঁজতে না হয় সন্তান।
——- লেখাটি টঙ্গীবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোসাম্মত হাসিনা আক্তার এর ফেসবুক আইডি থেকে নেয়া হয়েছে।
Be the first to comment on "মা দিবস,একদিনের অতিথি ও মায়ের দায়"