শিরোনাম

লুঙ্গি পড়ে নুসরাতের ‘হত্যাকারীকে’ জাপটে ধরে পুলিশ

ডেস্ক রিপোর্ট: আসামি ধরতে বিভিন্ন ছদ্মবেশ নিয়ে কৌশল অবলম্বন করতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ড সম্প্রতিকালের একটি স্পর্শকাতর ঘটনা। এই মামলার আসামিদের মধ্য অন্যতম হলো নূর উদ্দিন। তাকে ধরতে লুঙ্গি ও সেন্টু গেঞ্জি পড়ে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে কর্মরত এসআই মেহেদী হাসান। নূর উদ্দিনকে সফলভাবে গ্রেফতারের অন্যতম নায়ক এই পুলিশ সদস্য।

কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা হয় রাফিকে। নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হেনেস্তার মামলায় কারাবাসে ছিলেন নুসরাতেরই শিক্ষক সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা। এই সিরাজই কারাগারের বসে তার সহযোগীদের নির্দেশ দেন নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার জন্য। যে নির্দেশ মোতাবেক অন্তত ৩ যুবকসহ ৪ জন মিলে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের মধ্যে ‘শম্পা’ নামের এক নারীও রয়েছে, যা নুসরাত মারা যাওয়ার আগে ‘ডাইং ডিক্লারেশনে’ বলে গিয়েছিলো।

৬ এপ্রিল অগ্নিদগ্ধের পর শেষ পর্যন্ত নুসরাত টানা ৫ দিনের মাথায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ১০ এপ্রিল পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে বিদায় নেন। এ হত্যার সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে কড়াকাড়িভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন নির্দেশনায় অধিতর গুরুত্বের সঙ্গে নুসরাত হত্যা মামলায় জড়িতদের গ্রেফতারে তৎপর হয় পুলিশ। প্রথমে মামলাটি থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরবর্তীতে সেটি পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপরেই চিরুনি অভিযান শুরু করে পিবিআই।

 

তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সিরাজ-উদ-দৌলার অন্যতম সহযোগী ও সংশ্লিষ্ট মামলার আসামি নূর উদ্দিনের অবস্থান ময়মনসিংহের ভালুকায় জানতে পারে পুলিশ। পরে সেখানে গিয়ে লুঙ্গি ও সেন্টু গেঞ্জি পরে কৌশলেই পাকড়াও করে নূর উদ্দিনকে।

 

আসামি নূর উদ্দিনকে গ্রেফতারের চ্যালেঞ্জ নিয়ে জানতে চাইলে পিবিআইয়ের এসআই মেহেদী হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, আসামি ধরতে গিয়ে কত রকমের ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়, তা বলে শেষ করা যাবে না। একটি অভিযানে সফল করতে কী পরিমাণ ঝুঁকি নিতে হয় সেটিও বলার অপেক্ষা রাখে না। পালিয়ে থাকা একটা আসামি ধরাকে হয়তো অনেকেই পানিভাত মনে করে থাকেন। আসলে এই পালিয়ে থাকা আসামিকে ধরতে গিয়ে কতটা চ্যালেঞ্জ আর ঝুঁকি নিতে হয়েছে সেটি বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখা যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের পেছনের গল্পগুলো বেশিরভাগ সময় অপ্রকাশিতই থাকে সাধারণ মানুষের কাছে।

 

তবে প্রত্যেকটা অভিযানের পেছনে ঠিক এই রকম নানান স্মৃতি গেঁথে থাকে পুলিশের। কখনো কখনো সেই ঝুঁকি এত বেশি থাকে যে জীবন দিয়ে তার মূল্য দিতে হয়। তবুও দায়িত্বশীল পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালনে পিছুপা হয় না। ঝুঁকি আছে জেনেও এগিয়ে যান কর্তব্য পালনে। আমিও আমার কর্তব্য পালনে পিছুপা হইনি।

 

অপরাধী যেই হোক আমরা তাকে যে করেই হোক গ্রেফতার করার চেষ্টা চালিয়ে যাই। সাধারণত অভিযানে গিয়ে একটি কথা সবসময়ই মনে রাখতে হয় ‘সেফটি ফাস্ট’। কিন্তু এটি সবসময় সম্ভব হয় না। অভিযানে গিয়ে অনেক সময় এই কথা ভুলে যাই। আমার কাছে মনে হয়, যে করেই হোক পলাতক আসামিকে গ্রেফতার করতেই হবে।

মুন্সীগঞ্জের ছেলে এসআই মেহেদী জানান, এই অভিযানের সর্বক্ষণিক তদারকি করেছেন পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। এ ছাড়াও একই ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার আহসান হাবীব পলাশ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহেরুল হক চৌহান ও সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন অভিযানে যাওয়া টিমটিকে। এ ছাড়াও পুলিশ পরিদর্শক ওয়ালী উদ্দিন ও কামরুল ইসলাম ভালুকায় ওই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

 

ভালুকায় যে ঘর থেকে নূর উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই ঘরে সর্বপ্রথম ঝুঁকি নিয়ে কে প্রবেশ করেছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে এসআই মেহেদী হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ওই ঘরে লুঙ্গি আর সেন্টু গেঞ্জি পরে সর্বপ্রথম আমিই প্রবেশ করেছিলাম।

 

 

ঝুঁকি এড়াতে কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে? এমন প্রশ্নে মেহেদী হাসান বলেন, যেহেতু অভিযানস্থল একটি গ্রাম এলাকায়। আর সেখানে আসামি লুকিয়ে আছে। পোশাক পরিহিত পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আসামি পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিলো, তাই আমি লুঙ্গি আর সেন্টু গেঞ্জি পরি। আর অন্যান্যদের কেউ সিভিল পোশাকে, কেউবা ইউনিফর্মে দূরেই অবস্থান করছিলেন। আমিই সর্ব প্রথম ওই ঘরে প্রবেশ করে দেখি- অন্য এক পুরুষ আর এক নারী নূর উদ্দিনের পাশে বসে গল্প করছে। যে লোকটার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেই লোকটার চেহারা দেখা মাত্রই চিনতে দেরি হলো না আমার- ‘এই লোকটাই নূর উদ্দিন’। লাফ দিয়েই তাকে জাপটে ধরি এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ইশারামূলক আওয়াজ দিতেই ঘরের বাইরে থাকা আমার অন্য দুই সহকর্মী উপস্থিত হয়ে তাকে শক্তভাবে ধরে হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেয়। একই সময়ে অভিযানে আসা অন্যান্যদের বিষয়টি জানানো হলে তারাও উপস্থিত হয়ে আসামি নূর উদ্দিনকে ধরে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে ঢাকায় পিবিআইয়ের সদর দফতরে চলে আসি।

 

এই পুলিশ অফিসার আরো বলেন, নূর উদ্দিন যে বাড়িতে অবস্থান করছিলো, সেটি খুবই খোলামেলা জায়গায়। অন্তত আধা কিলোমিটার দূর থেকে কেউ আসলে সেটি স্পস্ট বোঝা যায়। এমন পরিস্থিতির কারণেই আমি সেখানে লুঙ্গি ও সেন্টু গেঞ্জি পরে যাই। যাতে তারা বুঝতে পারে আমি ওই গ্রামেরই কেউ। কোনো প্রয়োজনে হয়তো সেখানে যাচ্ছি।

 

যে বাড়িতে নূর উদ্দিন আশ্রয় নিয়েছিল, সেটি তার দূর সম্পর্কের মামির বাড়ি। ওই মামি গার্মেন্টে চাকরি করেন বলে জানা গেছে। ১১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাত ১ টায় ময়মনসিংহে পৌঁছান পিবিআইয়ের সদস্যরা। পরের দিন শুক্রবার বেলা ১১টা পর্যন্ত কলাকৌশল খাটিয়ে নূর উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। এই অভিযানের বিষয়ে শনিবার দুপুর সাড়ে ১২ টায় রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকাস্থ পিবিআইয়ের সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।

—– আজকের পত্রিকা

Be the first to comment on "লুঙ্গি পড়ে নুসরাতের ‘হত্যাকারীকে’ জাপটে ধরে পুলিশ"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*