শিরোনাম

পঁচাত্তরের ১৫ই আগষ্টের দুর্বিষহ সকাল।। কেহ হাঁসছে কেহ কাঁদছে

 

বীরমুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহাম্মেদ

১৯৭৫ খ্রী: ১৫ই আগষ্ট, আমি জগনাথ কলেজ-এ বি.কম অধ্যয়নরত,ফাইনাল পরিক্ষার প্রস্ততি নিচ্ছি, মা মারা গেছে প্রায় এক বৎসর হলো, মায়ের মমতা মাখা স্থৃতিগুলো তখনও আমাকে কাঁদায়, মাঝে মাঝে মায়ের জন্য হৃদয়টা মুঁচড়ে উঠে,গত বৎসর ১৯৭৪ সালে পরিক্ষা চলাকালিন সময় মা মারা যান,তাই পরিক্ষা শেষ করতে পারি নাই, সন্ধায় সম্ভুর আর্টের দোকানে আড্ডা মেরে বাড়িতে এসে রাতের খাবারের পর কিছু সময় পড়াশুনা করে রাত এগারটার সময় রেডিওতে সিলং ষ্টেশনে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।

নাছির ভাই আমার পাশের রুমে থাকে, বিয়ে করছে সবেমাত্র তিন বৎসর হলো। ভোর বেলা নাছির ভাই দরজায় নক করে আমাকে ডাক দেয়, কামাল, কামাল উঠ, আমি ঘুম ঘুম চোখে উঠে দরজা খুলে দেই, নাছির ভাই বলে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, আমি বললাম, কি বলছো, নাছির ভাই আবার বললো, তুই রেডিও শোন। আমি তড়িগড়ি করে রেডিও অন করে বাংলাদেশ বেতার ষ্টেশন চালু করলাম, কিছুক্ষন পর পর বলা হচ্ছে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, পরবর্তী এনাউন্সমেন্টের জন্য অপেক্ষা করুন।

আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পরলাম, কতক্ষন দ্বাড়িয়ে দ্বাড়িয়ে আমি এই দুঃসহ সংবাদ শোনছিলাম তার হিসাব নেই, নাছির ভাইয়ের ডাকে তন্ত্রা ফিরে এলো, নাছির ভাই বললো, যা হাত মুখ দূয়ে পড়তে বস,তোর ভাবি নাস্তা নিয়ে আসবে।

নাছির ভাই চলে যাওয়ার পর আমি রেডিওতে আকাশবানী কলিকাতা, অল ইন্ডিয়া রেডিও, ভয়েজ অব আমেরিকা, বিবিসি বিভিন্ন ষ্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যা নিশ্চিত হলাম, তখন কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য বেগম মুজিব,শেখ কামাল,শেখ হাসিনা,শেখ রেহানা,শেখ জামাল,শেখ রাসেল, শেখ কামাল ও শেখ জামালের স্ত্রী ও আমাদের মুন্সিগঞ্জের মহিউদ্দিন বিষয় কোন তথ্য জানতে পারি নাই, তারা বেঁচে আছেন কিনা?

সকাল সাতটার পর বাংলাদেশ বেতারে আবার এনাউন্সমেন্ট, আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, বার বার এই খবর প্রচার করা হচ্ছে, মাঝে মাঝে বলা হচ্ছে, পরবর্তী ঘোষনার জন্য অপেক্ষা করুন।

এমন সময় বাবার চড়া গলা ওই নাছির, কামাল তোরা কৈ? তোরা ঘরেই থাকিস,বাহিরে যাস না, সকাল ৮টার সময় বড় ভাই মিলে যাওয়ার সময় আমাদের বলে যায়, তোরা কিন্ত বাহিরে ঘোরাফেরা করিস না, কাহারো সাথে ঝগরা বিবাদ করিস না, ঘরেই থাকিস।

রেডিওতে অবিরাম প্রচারিত হচ্ছে মেজর ডালিমের ঘোষনা, আমি মেজর ডালিম বলছি,শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।

সকাল ৯ টাার দিকে রাস্তায় কিছুটা হট্রগোল শুনে বাড়ির গেটে এসে দাড়ালাম, দেখলাম কাসেম ভাই ২/৩ জনের সাথে তর্ক করছে, আমাকে দেখে কাসেম ভাই আমার কাছে এগিয়ে আসে, বিসন্ন কন্ঠে আমাকে বলে,কামাল বঙ্গবন্ধকে হত্যা করা হয়েছে,তুই শুনেছিস, আমি বললাম হ্যাঃ রেডিওতে শুনেছি, রাস্তায় লোকজনের চলাচল নেই বললেই চলে, মাঝে মাঝে ২/১ জন করে চলাচল করছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা স্বাধীনতার রিরোধীতা করেছিল, তারা খুবই উৎসাহ প্রকাশ করছে,২/৩ জন আমাদের পাশ কেটে উৎফুল্লচিত্রে চলে গেল, আমাদের দিকে ফিরেও তাকালো না, মনে হলো মুক্তিযুদ্ধ করে, আওয়ামী লীগ করে আমরা অন্যায় করেছি, তাদের চোখে আমরা যেন অপরাধী, কাসেম ভাই আর আমি আলোচনা করছি,বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, তারা কি অবস্থায় আছে, বঙ্গবন্ধুর চীফ সিকিউরিটি অফিসার(বডিগার্ড) আমাদের মহিউদ্দিন ভাই বেঁচে আছে কি না। এরই মধ্যে হত্যার সাথে জড়িত মুস্তাক এর নাম প্রচার হচ্ছে রেডিওতে, মুস্তাকের শপথ নেওয়ার ঘোষনাও হচ্ছে।

 

এমন সময় আমাদের গ্রামের মোঃ হোসেন(৪০)( মেউচ্চা) হাঁসতে হাঁসতে আসে, কাসেম ভাইকে(৩৫) বলে কিরে কাসেম শেওখ্যারে(শেখ মুজিব) মাইরা ফালাইছে, শেওখ্যার(শেখ মুজিব)খেইল খতম, টুপি জিন্দাবাদ, বলে নিজের মাথার টুপিটা হাত দিয়ে নাড়াচড়া করতে থাকে, মোঃ হোসেনের ছিল টাক মাথা, সবসময় মুস্তাকের ন্যায় টুপি পড়ে থাকতেন।

যাওয়ার সময় কাসেম ভাইকে মেউচ্চা বলে যায়, সাবধান হয়ে যা, আর আওয়ামী লীগ মারাইছ না, টুপি জিন্দাবাদ বলতে বলতে চলে যায়।

আওয়ামী লীগের লোকজন তেমন ঘরের বাহিরে আসে নাই, স্বাধীনতা বিরোধী লোকজন সংগঠিত হতে থাকে, পথে ঘাটে তাদের তৎপরতা বাড়তে থাকে।

একসময় দোকানে যাই, দোকানে এসে নানান জন নানা ধরণের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কুটক্তি করতে থাকে, বড় ভাই আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, বাড়িতে এসে শুয়ে শুয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের এবং মহিউদ্দিন ভাইয়ের খবর নিতে রেডিওতে বিভিন্ন ষ্টেশনে খবর শুনতে থাকি।

 

Be the first to comment on "পঁচাত্তরের ১৫ই আগষ্টের দুর্বিষহ সকাল।। কেহ হাঁসছে কেহ কাঁদছে"

Leave a comment

Your email address will not be published.


*